প্রবীর বিকাশ সরকার: বাঙালির মতো জাপানিরাও অত্যন্ত আবেগপ্রবণ জাতি। কিন্তু তাদের আবেগ-পরিমিতবোধ বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে যায় না। কারণ জাপানিদের জাতিগত স্বভাব বা বৈশিষ্ট্য। জাপানিরা লজ্জাকে সর্ব ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। বাঙালিরা লজ্জা কী জিনিস, জানে না। কিন্তু একসময় বাঙালির জাতিগত বৈশিষ্ট্য ছিলো অঙ্গীকার। ভারত স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত বাঙালির প্রতিটি কাজের চিন্তায় অঙ্গীকারবোধ ছিলো। রাজা রামমোহন রায় থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু পর্যন্ত বাঙালির মহান ব্যক্তিদের কর্মজীবনে অঙ্গীকারের অনুরণন আমরা ইতিহাসে শুনতে ও জানতে পাই। 

ভারত স্বাধীনতার পর বাঙালির সব গুনাগুণ বা বৈশিষ্ট্য কর্পূরের ঘ্রাণের মতো উবে গেলো। কারণ দুর্বিনীত স্বভাব ক্রমে ক্রমে নাবালক রাজনীতির হাত ধরে সমাজের মাথাগুলোকে গ্রাস করতে লাগল। তারপরও যে সামান্য অঙ্গীকারবোধ অবশিষ্ট ছিলো তাও হাওয়ায় বিলীন হয়ে গেলো পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর। বাঙালি এখন দুর্বিনীত, বেপরোয়া এবং বেসামাল জাতির রূপ পূর্ণাঙ্গভাবেই পরিগ্রহ করেছে। বাঙালি এখন অশুভ ভূতগ্রস্ত জাতি। দুই বাংলার গণমাধ্যম প্রতিক্ষণ সেই চিত্রই কি তুলে ধরছে না? 

বাঙালির অঙ্গীকার ছিলো বিদেশি শাসকদের কবল থেকে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠা করবে, দুর্নীতিমুক্ত সুষম সমাজ গড়বে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলবে, ধর্মকে প্রাধান্য দেবে না, নারী শিক্ষার বিস্তৃতি ঘটাবে ইত্যাদি। বিগত ৭৫ বছরেও যে কিছুই করতে পারেনি, একটা অঙ্গীকারও বাস্তবে রূপ দিতে পারেনি তা দিনের আলোর মতো সুস্পষ্ট। 

বাঙালির কৌতূহল, উদ্ভাবনী চিন্তা এবং নতুত্বের প্রতি অদম্য আগ্রহের সঙ্গে জাপানিদের মিল দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রযুক্তির উন্নতি, সহজলভ্যতা ইন্টারনেটের কল্যাণে আজ রমরমা অবস্থা বিশ্বজুড়েই। দুই বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এই সুযোগের সদ্ব্যবহার সম্পর্কে বাঙালির ধ্যানধারণাই নেই। হুজুগে বাঙালি বলে যে দুর্নাম আছে বাঙালির, তার উজ্জ্বল প্রমাণের ভুরি ভুরি উদাহরণ ইন্টারনেট জুড়ে ঘুরছে। লজ্জা এবং বিভ্রান্তিকে স্ফীত করেই চলেছে দুর্বিনীতভাবে। 

শতশত মুদ্রিত পত্রিকা, ম্যাগাজিন এবং অনলাইন পোর্টাল ইত্যাদি প্রতিদিনই জন্ম নিচ্ছে ব্যাঙের ছাতার মতো। আর এগুলোর অধিকাংশেরই প্রকাশক, সম্পাদক ও সাংবাদিক হচ্ছে নাবালক এবং দুর্বিনীত। না জানে মাতৃভাষা, না আছে ভাষাজ্ঞান, না আছে সভ্যতা-ভব্যতার ধারণা। খামখেয়ালি আর ভুলভালে সয়লাব বাংলা ভাষার জগৎ। কোনো শিক্ষা নেই, নিয়মনীতি নেই, কোনো প্রকার নিয়ন্ত্রণও নেই। এমনই স্বাধীন এখন বাঙালি যে স্বৈরাচার শাসকও ব্যর্থ নিয়ন্ত্রণ করতে। 

মাতৃভাষায় ব্যক্তির নামটি পর্যন্ত শুদ্ধ করে লেখার সাধারণ জ্ঞানটুকু জলাঞ্জলি দিতে মোটেই দ্বিধান্বিত নয় নতুন প্রজন্ম। নয় লজ্জিত। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী একজন খ্যাতিমান লেখক ও পুরাণবিশেষজ্ঞ। তাঁর নামটি বিছিন্নভাবে লিখে, পুরাণকে পুরান লিখে নির্লজ্জভাবে প্রচার করা হচ্ছে। দায়িত্বশীল কর্মকর্তাও যেমন দেখছে না, পাঠক বা দর্শক-শ্রোতাও কেউ প্রতিবাদ বা সংশোধনের কথা বলছেন না। এরকম নামের ভুল, বানান ভুলে ‘আ মরি বাংলা ভাষা’ কাঁদছে। কই জাপানি বা অন্য জাতির লোকরা তো এতো ভুল করে না। বাঙালি কেন করে? পণ্ডিতদের ভাষ্য কী এই ব্যাপারে? 

প্রবীর বিকাশ সরকার: লেখক ও গবেষক